মুনার ঘুম আজ সকালে বাড়ির লোকের চিৎকারে ভেঙ্গে গেছে। সে হৈ চৈ শুনে ঘুম থেকে উঠে দৌঁড়ে বারান্দায় এলো। এসেই সে যা দেখলো তা তার কাছে এক আশ্চর্য ও অনভিপ্রেত। তার মায়ের হাতে এক ছোট্ট সুন্দর টিয়া পাখী। যা সে এতদিন মনে মনে কল্পনা করতো আজ তা-ই তার চোখের সামনে। খুশীতে তার কচি মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে মায়ের কাছে জানতে চাইলো, “মা এই পাখীটা কোথা থেকে এলো? তুমি এটা কোথায় পেলে?” মা হেসে জবাব দিলেন, আমি ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে যেই বারান্দায় এসে বসেছি, অমনি কোথা থেকে উড়ে এসে টিয়া পাখীটা আমার কাছে এসে বসেছে। আমিও সুযোগ বুঝে পাখীটা ধরে ফেললাম। তারপর বুয়াকে দিয়ে ওর পায়ে দড়ি বাঁধলাম। রুনা আর রুমু এসে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিল আনন্দে! মায়ের কথা শেষ হবার আগেই মুনা হেসে বললো, আর সেই চিৎকার শুনেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওরা সবাই তখন একসাথে হেসে উঠল। এমন সময় মুনার বাবা বারান্দায় এলেন, সবাইকে একসাথে দেখে বললেন, তোমরা সবাই পাখীটাকে বেঁধে রেখেছো কেন? যাও ওকে ছেড়ে দাও, যেখান থেকে এসেছে সেখানেই চলে যাক। এ কথা শুনে মুনার আত্মা খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড়। তার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠলো, সে কোনমতেই তার স্বপ্নের পাখীটাকে হাত ছাড়া করতে রাজী নয়। তাই সে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললো, মা আমি এই পাখীটাকে পুষবো, তুমি বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলোনা। মায়েরও ইচ্ছা পাখীটা এখানেই থাক। তবুও তিনি রুনা ও রুমুকে জিজ্ঞেস করলেন তাদের কি অভিমত। তারাও মুনার প্রস্তাবে সাঁয় দিলো। তখন মা গিয়ে বাবাকে বুঝালেন, ছেলে-মেয়েদের বায়নার কথা। বাবা বললেন, রাজী আছি এক শর্তে, ওদের পড়ালেখা যেন ঠিকমত হয়। মা এসে জানালেন তাদের বাবার সম্মতির কথা। তখন তারা তিন ভাই-বোন সবাই মিলে বলে উঠলো হুররে কি মজা! ঐদিনই বিকালে মা টিয়া পাখীটার জন্য সুন্দর দেখে একটা খাঁচা কিনে আনলেন। মুনা সকাল থেকেই টিয়া পাখী যা যা খায় তা যোগাড় করতে ব্যস্ত ছিল। টিয়া পাখীকে সে বাদাম, কলা, দুধ-ভাত, মরিচ আর ভেঁজানো ছোলা খাওয়ালো। টিয়াটাও কি সুন্দর করে খেলো, যেন কতদিনের আপন। মুনারা তিন ভাই-বোন। রুনা ১০ম শ্রেণী, রুমু ৮ম শ্রেণী ও মুনা ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। মুনা এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে। তার মা তাকে খুবই ভালবাসেন। বাবা খুব রাশভারী মানুষ। তিনিও তার সন্তানদের খুব ভালবাসেন, কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করেন না। উনার ধারণা ভালবাসা প্রকাশ করা দুর্বল চিত্তের লক্ষণ। তাই তিনি সবসময় ছেলে-মেয়েদের শাসন করেন। কিন্তু ভালবাসা প্রকাশ করেন খুব কম। তারা সব ভাই-বোন বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। তাদের যত আবদার সব মায়ের কাছে। তাদের মা খুব ভালোমানুষ। দয়া-মায়া, স্নেহ-মমতায় পূর্ণ প্রাণ। কারও দুঃখ কষ্ট তিনি সইতে পারেন না, পশু-পাখীর জন্যও তার অনেক মায়া। মুনা তার মায়ের এই গুণটাকে খুব পছন্দ করে।
পরদিন বিকালে মুনাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এক দূর সম্পর্কের চাচা বেড়াতে এলেন। খাঁচার ভিতর পাখী দেখে বললেন, এই পাখীটা কে পুষে? তখন মুনা তার চাচাকে আগের দিনের সব ঘটনা খুলে বলে। চাচা বলেন, আমিও একটা টিয়া পালতাম, কিন্তু কথা শিখার সময় সে মারা গেছে। তা মামণি তোমার পাখীটার কি নাম রেখেছো? মুনা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো, আমি ওর নাম রাখলাম মিঠু। মুনা প্রায়ই টিভিতে মিনা কার্টুন দেখে। সেখানে মিনার একটা টিয়া পাখী আছে, যার নাম মিঠু। মিনা কার্টুন দেখতে দেখতেই আসলে সে স্বপ্ন দেখতো তারও একটা টিয়া পাখি আছে, তার সাথে গান গায়, কথা বলে, ঘুরে বেড়ায়। মিনাকে সে খুব ভালবাসে। মনে মনে মিনা হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে।
চাচা বললেন, এসো তো মা, এই মিঠুর দরজাটা আমরা খুলে দেই। মুনা বলে, না তাহলে মিঠু আমায় ছেড়ে চলে যাবে বহুদূর দেশে। চাচা বললেন, না সে যাবেনা, তুমি যদি সত্যি তাকে ভালবাস তাহলে সে কখনও তোমায় ছেড়ে যাবেনা। এসো তোমার হাতে মিঠুকে বসিয়ে দেই। মুনা ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ায়। চাচা মুনার হাতে মিঠুকে বসিয়ে দিতেই মুনার কেমন অদ্ভূত অনুভূতি হয়, সে সাথে সাথে মিঠুকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। বলে, চাচা মিঠুর পায়ের নখগুলো আমার হাতে বসে যাচ্ছে, কেমন চিমটি কাটার মত লাগে। চাচা বললেন, প্রথম প্রথম এমনই হয়, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। মুনা আবার মিঠুকে হাতে তুলে নিলো। এবার সে আর ভয় পেলোনা। মিঠু তার হাত বেয়ে কাঁধে উঠলো। আবার কাঁধ বেয়ে বেয়ে হাতে নেমে এলো। মুনা অভিভূত হয়ে গেলো। একটু একটু নখের আঁচড়ে তার কষ্ট হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু মিঠুর প্রতি ভালবাসা থাকায় সে সেটা সহ্য করে নিলো। তার মুখে আনন্দের মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। তার আনন্দ দেখে মায়ের মনেও খুব আনন্দ হলো। এবার তার একটা স্বপ্ন পূরণ হলো। তার আরেকটা স্বপ্ন হলো মিঠুর সাথে কথা বলা।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত যায় মুনা মিঠুকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। স্কুল আর বাসা, বাসা আর স্কুল এই ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। এখন বাসা মানেই মিঠু, বাসা মানেই আনন্দ। মিঠুকে পেয়ে মুনা বেড়াতে যাওয়াও ভুলে গেলো। বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই মিঠুকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য বায়না জুড়তো। কিন্তু তার এসব কথায় কেউ পাত্তা দিতনা। বাবা রাগ করে বলতেন, এসব কি? সারাদিন শুধু মিঠু, মিঠু আর মিঠু, এছাড়া কি আর কোন কথা নেই? পড়তে বসলে মিঠু, খেতে বসলে মিঠু, বেড়াতে গেলে মিঠু, ঘুমাতে গেলে মিঠু আর সহ্য হয়না ছাই। আমি আজই মিঠুকে ছেড়ে দিবো। মুনা তার বাবার এ কথায় ভীষণ কষ্ট পায়। সে বাবাকে বলে, আমি আর কখনও পড়তে বসলে মিঠুকে নেবোনা, তুমি দয়া করে আমার মিঠুকে ছেড়ে দিওনা বাবা। ওর বাবা শুধু কড়া চোখে চাইলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
একদিন হলো কি? মিঠুর দরজাটা মিঠু নিজেই ঠোঁট দিয়ে কামড়াতে কামড়াতে খুলে ফেললো। সময়টা ছিল শেষ বিকেল। মুনা বিকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো মিঠুর খাঁচার দরজাটা খোলা। মিঠু নেই! মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন, মিঠু এখন দরজা খুলতে শিখে গেছে, বনের পাখিকে কেউ বশে আনতে পারেনা, তাদের মন সবসময় মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ায়, যে চলে গেছে তাকে চলে যেতে দে। তার জন্য তুই আর মন খারাপ করিসনা। মুনা আর ভাবতে পারছেনা, এত আদর-যত্ন দিয়ে যাকে সে বড় করলো, সে কিনা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার চাচার কথাটা মনে পড়ে গেলো, “ তুমি যদি সত্যি তাকে ভালবাস তাহলে সে কখনও তোমায় ছেড়ে যাবেনা।।” তবে মিঠু কেন চলে গেল? তবে কি তার ভালবাসায় কোন ফাঁক ছিল? সেতো মন প্রাণ দিয়েই মিঠুকে ভালবেসেছে। তবে কেন মিঠু চলে গেলো তাকে দুঃখ দিয়ে। মুনার দু’চোখের জল যেন আর বাঁধ মানেনা। অবিরত জলধারায় সিক্ত হয় তার কোমল মুখ। এদিকে সূর্য্যিমামা রাতের চাদরে মুখ ঢেকে বিদায় নেয়। আকাশে ঝলমল করে উঠে সুন্দর রূপালী চাঁদ, ঝিকিমিকি ছোট্ট তারা। ভরা পূর্ণিমার রাত মুনার অতি প্রিয় একটি মুহূর্ত। কিন্তু আজ আর চাঁদের সৌন্দর্য্য মুনার ছোট্ট মনে সাড়া জাগায় না। সে আপন মনে চাঁদ মামার সাথে কত কথা কয়ে যায়, কেউ জানেনা। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ ফুলে লাল হয়ে যায়, মুখটাও ফোলা ফোলা লাগে। ভাইয়া, আপু মিছে স্বান্তনা দিয়ে যায়, বলে, তোকে আরেকটা পাখি কিনে দেবো, দরকার হলে একসঙ্গে দুটো পাখি। তবুও মুনার মন ভরেনা, তার কানে শুধু কেবল বাজে মিঠুর ডাক __ মিঠু, মিঠু, মিঠু, টিয়া, টিয়া, টিয়া।
সারারাত মুনার ঘুম হয়না মিঠুর চিন্তায়। কোন ঝোপে পড়লো না তো সে, কোন বিড়াল কিংবা কুকুর খেয়ে ফেললো নাতো তাকে? এসব ভাবে আর কাঁদে। এমনি করে ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। মুনার কষ্ট দেখে মায়ের চোখেও জল ভরে আসে। তিনিও মেয়ের চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারেন না। একসময় রাত্রি শেষ হয়। ভোরে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে মসজিদ হতে। মা নামাজ পড়ে মুনাকে ডেকে তুলেন, বলেন, চল আমরা মিঠুকে খুঁজে নিয়ে আসি, ওতো ছোট্ট, ভালো করে উড়তে পারেনা, নিশ্চয়ই কেউ ধরে ফেলেছে। মায়ের কথা শুনে মুনার মনে আশার সঞ্চার হয়। সে খুশী হয়ে উঠে। কাল সারারাত ধরে কাঁদার ফলে তার চোখ ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। তার চোখ ভীষণ জ্বালা করছিল। কিন্তু মিঠুকে খুঁজতে যাবার কথা শুনে তার আর তর সইলোনা। এমনিতেই শীতের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বাতাসে কুয়াশার আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মুনার যেন কিছুতেই লক্ষ্য নেই, সে শীতবস্ত্র না নিয়েই মায়ের হাত ধরে ছুটে চললো মিঠুকে খুঁজতে। আশে-পাশের ঘর-বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ। যেদিক দিয়ে মিঠু উড়ে গিয়েছিল, সেদিক দিয়ে মা নিয়ে চললেন মুনাকে। পূব আকাশে সূর্য্যিমামা তখনও উঁকি দেয়নি। একটা বস্তিমত জায়গায় এক মহিলা কি জানি খুঁজা-খুঁজি করছিলেন। মা এসে সেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল সন্ধ্যার দিকে আশে-পাশে কোন টিয়া দেখেছে কিনা। মহিলাটি জানালেন, ঐ যে একটা সাদা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, ঐ বাড়িতে সন্ধ্যায় একটা টিয়া পাখি ধরা পড়েছে। ওখানে গিয়ে খোঁজ করেন, পাবেন। মা মুনাকে নিয়ে মহিলাটির দেখিয়ে দেয়া বাড়িটির দরজার দিকে গেলেন। নক করতেই একজন লোক বেড়িয়ে এলেন। টিয়া পাখির কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি অস্বীকার করলেন। মুনার তখন ভয়ানক রাগ হলো। সে বললো, ঐ তো ঐ মহিলাটিই তো বলেছেন, আপনারা গতকাল টিয়া পাখি ধরেছেন। তখন লোকটি লজ্জা পেয়ে তার স্ত্রীকে ডাকলেন এবং পাখির কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারা কোন পাখি ধরেছে কিনা। স্ত্রী হেসে বললেন, হ্যাঁ কিন্তু কেন? পাখির কথা জিজ্ঞেস করছ কি জন্য? তখন মা উনাকে সব খুলে বললেন। সব শুনে তিনি মুনাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং একটা ছোট্ট খাঁচা থেকে মিঠুকে বের করে দিলেন। কৃতজ্ঞতায় আর আনন্দে মুনার চোখে জল ঝরে পড়ল। সে মহিলাটিকে ধন্যবাদ দিয়ে মায়ের সাথে বাসার পথ ধরলো। এমন সময় সূর্য্যিমামা কুয়াশার চাদর সরিয়ে রাঙা আলো নিয়ে পূব আকাশে উদয় হলো। মুনার মনের সব কষ্টগুলো যেন এক নিমিষেই ঝরে পড়লো।